Categories


অষ্টম গর্ভ-২

মনুষ্য লেভেলে নামিয়া আসিলেই আমাদের বিচার, দৃষ্টিভঙ্গি সকলই পাল্টাইয়া যায়। মানবজগৎ বড়ই জটিল। মানবের সুখ-দুঃখের হিসাব, ভাল-মন্দের মানদণ্ড অত সহজ নহে। তাই, উপরের লেভেলে পুরাণ লেখা হয়, মনুষ্যে উপন্যাস লেখে। উপন্যাস মনুষ্য চরিত্র, তাহাতে নানা বর্ণছায়ের খেলা, তাহার জীবনের চলনপথ এই সকল লইয়া ব্যাপৃত হইয়া থাকে। মহা আনন্দে, কেননা ইহা সােজা সরল নয়। উপরন্তু ইহা সত্য অথচ সর্বাংশে সত্য নয়, বিস্তর বানানাে-বিনাননা আছে, তাহাতেই মজা, ছিল রুমাল হইয়া গেল বিড়াল। ক-এর বাবার সঙ্গে গ-এর জ্যাঠামশাইকে চালিয়া চালিয়া চালনিতে মিশানাে হইল, কিছু রং চড়িল, কিছু রং ওয়শ করিয়া করিয়া ফিকা হইল, আরও কতক অদ্ভুত রাসায়নিক পরিবর্তন হইল, উপন্যাসের পিতা দুগগি তৈয়ার হইলেন।


পন্ডিত মশাই

নিরীহ কুঞ্জ আর কথা কহিতে পারে না। তাহার এই শিক্ষিতা তেজস্বিনী ভগিনীটির সুমুখে সে কেমন যেন থতমত খাইয়া যায়। তথাপি সে ভাবে, আর একরকম করিয়া। সে বড় দুঃখী। এই দুখানি কুটীর এবং তৎসংলগ্ন অতি ক্ষুদ্র একখানি আম-কাঁঠালের বাগান ছাড়া আর তাহার কিছু নাই। অতএব নগদ এতগুলি টাকা এবং এত জোড়া ধুতিচাদর তাহার কাছে সােজা ব্যাপার নহে। তবুও এই প্রলােভন ছাড়াও, সে তাহার একমাত্র স্নেহের সামগ্রীকে এই ভাল জায়গাটিতে সুপ্রতিষ্ঠিত করিয়া, তাহাকে সুখী দেখিয়া নিজেও সুখী হইতে চাহে।


সেরা নবীনদের সেরা গল্প

সাহিত্য শিল্পের একটা ঐতিহ্য আছে। ধারাবাহিকতা অস্বীকার করা মুশকিল। সচেতনভাবেও কি তা অমান্য করা যায় ? বােধ হয় নয়। এই সংকলনেই এমন কয়েকটি লেখা আছে যা আমাদের বাংলা ছােটগল্পের ঐতিহ্যকেই মনে করিয়ে দেয়। এতে দোষের কিছু আছে বলে আমি মনে করি না। লেখক মাত্রেই তাঁর মনােমতন লিখবেন—সেটাই তাে স্বাভাবিক। পাঠকের পছন্দ হােক না-হােক লেখক কেনই বা অন্যের মরজিতে লিখতে যাবেন!


তিলাঞ্জলি

বালিগঞ্জ প্লেসের এই একতলা বাড়িটার দক্ষিণ কোণের ঘরটা সত্যিকারের আর্টিস্ট ভাবুক মানুষের পক্ষে একটি আদর্শ আশ্রয়। জানালার পাশেই মাঠটার আরম্ভ। কলকাতার বর্ষার আদরে ঘাসভরা মাঠটা যেন আহ্লাদে কেঁপে উঠেছে সতেজ সবুজে কানায় কানায় ভরা। চারদিকের পীচ ঢালা চারটে রাস্তা যেন পালিশ করা চারটে কালাে ফ্রেম, এই সবুজের উচ্ছলতাকে শক্ত করে বেঁধে রেখেছে। জানালার ঠিক বাইরেই পর পর কতগুলি কাঠাল আর শিউলি—একটা বারােমেসে. ছায়া জায়গাটাকে যেমন ঠাণ্ডা তেমনি স্যাতসেঁতে করে রেখেছে। গাছের গােড়ায় কদিন থেকে ঝরা শিউলি জমে উঠেছে।


ঢেউ আসে ঢেউ যায়

কামরা থেকে একটা একটা করে মালপত্র নামাচ্ছিল শুভ্র আর পল্লব। ব্যস্তসমস্ত মুখে। সতর্ক চোখে। একটু অসাবধান হলেই কে কোথায় কোন্ মাল নিয়ে চম্পট দেয় তার ঠিক কী! পুরী ধর্মস্থান বটে, তবে কে না জানে পুণ্যক্ষেত্রেই চোর ছাচোড়ের উপদ্রব বেশি। জগন্নাথ এক্সপ্রেস আজ ঘণ্টা দেড়েকের ওপর লেট। ভুবনেশ্বর অবধি ঠিকঠাকই চলছিল, খুদাররাডে এসে খামােকা দাঁড়িয়ে রইল নিঝুম। ছাড়েই না, ছাড়েই না। যাও বা ছাড়ল বাকি পথ এল খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। একটু থামে, একটু চলে, থামে... কোথায় সাড়ে পাঁচটায় ইন করে যাওয়ার কথা, সাতটা বাজিয়ে দিল।


দোয়েল সাঁকো

আলাে অন্ধকারে মেশানাে একটা সকাল আজ। ভেজা হাওয়ায় কেমন যেন মন খারাপ করা গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছে। চোয়াল শক্ত করে দৌড়ােনাে এই শহরের চোখেও আজ যেন আনমনাভাব। একলা চড়াই হয়ে সকলে যেন বসে আছে নির্জন বারান্দায় আর আমায় বলছে, ও নেই! বলছে, এ জীবনের মতাে ও চলে গিয়েছে আমায় ছেড়ে। আমি ওড়না দিয়ে মুখটা মুছলাম। মেঘ করে থাকায় সারা কলকাতা জুড়ে আজ কেমন একটা কম্বলচাপা গরম। ছােট গলিটা থেকে বড় রাস্তায় বেরিয়ে দাঁড়ালাম একটু। মনখারাপের মাঝেও হঠাৎ হাসি পেল! কোন দিন ও আমার ছিল? জ্ঞান হওয়ার পর থেকে তাে ওকে দেখছি! কিন্তু তাও কোনও দিনও কি আমার ছিল ও?


শ্রীমতী রাধার শেষ সংবাদ

গােলােকে আজ মহা গােলযােগ। বসুন্ধরাকে নিয়ে দেবতারা সব আসছেন। তাঁরা এই মুহূর্তে রয়েছেন ব্রহ্মার দরবারে। পৃথিবীতে পাপ বেড়েছে। দৈত্যকুল সব ছারখার করে দিচ্ছে। এখন সেখানে বরাহকল্প। অসুরদের উৎপাতে সেখানে আর টেকা যাচ্ছে না। দেবতারা চিরকালই দুর্বল। তারা ধরিত্রীমাতাকে নিয়ে ব্রহ্মসভায় ব্রহ্মার কাছে এসেছেন। দুর্গম পথ পেরিয়ে তারা এসেছেন। ক্লান্ত, শ্রান্ত, উদ্বিগ্ন। একমাত্র স্রষ্টাই পারবেন সৃষ্টির বিনাশ ঠেকাতে। কেন তিনি অসুর সৃষ্টি করলেন— এ প্রশ্ন অবান্তর। কোনও কিছু সৃষ্টি করতে গেলেই অনাসৃষ্টি অবশ্যম্ভাবী। যেমন চিনির রস জ্বাল দিলেই গাদা বেরােবে। ঘি জ্বাল দিলেই খানিকটা ছাঁচ। ও হবেই।


প্রথম প্রবাহ

গণপতি তাঁর হস্তিমুণ্ডটি ঈষৎ আন্দোলিত করে বললেন, “ঋষিবর! এই মহাগ্রন্থের অবতরণিকা অংশে আপনি বলেছিলেন, ধর্মে চার্থে কামে চ মােক্ষে চ, অর্থাৎ ধর্মঅর্থকামমােক্ষ— এই চতুর্বর্গ সম্বন্ধে যাবতীয় তত্ত্বের আকর হবে এই মহাভারত। কিন্তু এখনও অবধি যতগুলি শ্লোক আপনি রচনা করেছেন এবং আমি অনুলিখন করেছি, তার মধ্যে সেই মহৎ অভিপ্রায় তাে পরিস্ফুট হল না।” মহাকবি কৃষ্ণদ্বৈপায়ন মৃদু হাস্যকরলেন। তারপর ঈষৎ কৌতুকজড়িত কণ্ঠে বললেন, “দেব লম্বােদর, আপনার উদর যতটা বিপুল, ধৈর্য তত পরিমাণেই অপ্রতুল দেখি! এ যে সবে আদিপর্ব! গ্রন্থ অনুলিখনের প্রাক্কালেই তাে বলে দিয়েছিলাম, অষ্টাদশ পর্ব অবধি বিস্তৃত হবে এ কাহিনি।”


পঞ্চপাণ্ডব ও যাজ্ঞসেনী

ছােট্ট বাংলাে-বাড়িটার কাঠের রেলিং ঘেরা বারান্দায় বসে আছে ওরা। ভুটান রাজ্যের প্রাক্তন রাজধানী পুনাখায়। বাড়িটা পাহাড়ের ঢালে, গঞ্জের কোলাহল ছাড়িয়ে। অথচ গুম্ফাটা স্পষ্ট দেখা যায় এই বারান্দায় বসলে। আর দেখা যায় বালিপাথরে বুকভরা মাে চু আর পাে চু নদী দু’টোকে। যারা এসে মিলিত হয়েছে গুম্ফাটার গায়ের ঠিক পাশটিতে।


রমণীরতন

ছােট জামাটা পরে পিঠের দিকে হাত ঘুরিয়ে হুকের নাগাল পাচ্ছিল না রতন। দুটো মাথা ধরে একটু টানাটানি করল। নাঃ, হচ্ছে না। ধুর-ধুর, এভাবে একা-একা কি হয়! সরস্বতীটা অন্যদিন থাকে। এই ছােট জামা, ব্লাউজ পরিয়ে দেওয়া, শাড়ির কুঁচি ঠিক করে দেওয়া, এই কাজগুলাে ওকে দিয়েই করায় রতন। কিন্তু আজ ওর শরীর খারাপ। গত মাসে প্রথম ঋতুমতী হল সরস্বতী। প্রথম-প্রথম ততা, পেটে খুব যন্ত্রণা হচ্ছে। একটু আগে দেখে এল বেচারি বিছানায় শুয়ে পেট চেপে ধরে কোঁকাচ্ছে। একটা কিছু ওষুধবিষুধ দিতে পারলে হত মেয়েটাকে। রতন কতবার বলেছে যে, দলে একটা কম্পাউন্ডার গােছের লােক রাখলে হয়। যে লােকটা ছােটখাটো জ্বরজারি, পেটখারাপ, ব্যথাবেদনায় ওষুধ দিতে পারবে। এমনিতেই দল নিয়ে চরকিপাক খেতে হয়। বছরের মধ্যে আট-ন’ মাসই এক জায়গা থেকে আর-এক জায়গা ঘুরে বেড়ানাে।